এখানে নদী বাঁক নিয়েছে । শান্ত জল । অন্ধকার চারিদিক। পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি , আমরা কোন কথা বলছি না । পেছনে ঝিঁঝিঁ আর ব্যাঙের বুকচেরা চিৎকার ভেতরটা ফাঁকা করে দিচ্ছে। এভাবেই আমরা এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম ঠিক আট ঘণ্টা আগে । এখন রাত ২: ৩০ । আমি সিওর তুই ঘুমোস নি , গাঁজা টেনে শূন্যে মেঘেদের সাম্রাজ্যে আছিস । তোরও কি এই মধ্যরাতে মনে পড়ছে আমার কথা ?
আগের রাতে ঘুমিয়েছি ওই চারটে । বহুদিন পর তোর ফোন এলো সাড়ে চারটে সময় । ব্যস স্ক্রিনে তোর নাম দেখে ঘুম গেল মর্নিং ওয়াকে । একি কাঁদছিস কেন ? আচমকা বিদ্যুতের মত উড়ে এলো আবদার । আমায় একটা দিন দিবি ? না করা আমার সাধ্যে ছিল না । তারপর ? তারপর শুনবেন !
তারপর আমার পক্ষীরাজ রেডি ডানা মেলার জন্য । ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে সে উড়ছে । পরের শহরে পৌঁছে সে পিঠে চাপিয়ে নিল রাজকন্যাকে । হা হা তা বলে আমায় আবার কোন রুপকথার যুবক ভাববেন না । যাইহোক , আমরা ভর দুপুরে নদী পাড়ে গেলাম , রোদের তেজে ফিরেও এলাম । আরেকটু এগিয়ে একটা গ্রাম , আরেকটা গ্রাম তারপর আরো একটা পেরিয়ে ইউক্যালিপটাশ ঘেরা ঝিল । নীল জল । দুজন ঘাটে বসে মাছ ধরছে , এক মহিলা বাসন ধুচ্ছেন । তোর ঠোঁটের সিগারেটে আমি আগুন দিলাম । ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে উপরে । আমার চোখে চোখ রেখেছিস কিন্তু কিছু বলছিস না । কি দেখছিস ? আমার চোখে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ আছে ,আছে জঙ্গল , আছে কমলা রাস্তা , আছে তোর চুলের মত ঢেউ খেলানো নদী আর কলেজ ডুব মারা দিনের বোহেমিয়ান সময় । এবার তাকালি ঝিলের দিকে । নীল জল , ভাসমান কটা হাঁস । তোর ঠোঁট স্পর্শ করা সিগারেট আমার ঠোঁট ছুঁলো । আমরা আরেকটু মনের এবং আরেকটু ধ্বংসের কাছাকাছি এলাম । কেন ডাকলি ? কেন কাঁদছিলি ? কেনই বা আমরা এখন প্রকৃতির এত কাছাকাছি ? সব কেনর উত্তর হয় না । এই পাশাপাশি বসা , এই নিরবতার থেকে যথার্থ শব্দ সত্যিই আমাদের কাছে নেই বিশ্বাস করুণ । শুধু তার হাতে হাত রাখাটাই মুহূর্ত । আর সেই কলেজবেলার মত করে সে গেয়ে উঠল –
Suzanne takes you down to her place near the river
You can hear the boats go by
You can spend the night beside her
আমি জলের দিকে তাকিয়ে আছি । ফ্ল্যাশ ব্যাকে ভেসে উঠছে একটা রোদ মাখা রাস্তা , পাশে ঘুপচি চায়ের দোকান । বাস থামল । নামলি , অন্যান্য দিনের মত সেদিনও দেখিস নি । প্রতিদিনের মতই জিন্স – কুর্তি , কাঁধে সাইড ব্যাগ । হেঁটে যাচ্ছিস কলেজের গেটের দিকে ।
And you know that she’s half crazy
But that’s why you want to be there…
গানটা থেমে গেল । হাত থেকে হাত সরিয়ে বলল - চল জঙ্গলে যাই । আমরা আবার চললাম । কলেজ ছাড়ার আজ এত বছর পর আমরা আবার কেন দেখা করছি ! জানি না । দুদিকে অসংখ্য সবুজ রেখে এগোচ্ছি । আজ আমার জঙ্গল ভালো লাগছে না । সব সবুজেরই যেন এক রঙ , পাখির ডাক কান পেরিয়ে মনে গিয়ে লাগছে না । তার নরম পারফিউমকে অগ্রাহ্য করে জঙ্গলের বুনো গন্ধ নিতে পারছি না । আমাদের দুজনের ঠোঁটে সিগারেট জ্বলছে , মাটির রাস্তা ধরে চলেছি , জঙ্গল ঘন হচ্ছে । সে কানের কাছে খুব আসতে গান ধরেছে , তার স্বর কান হয়ে মনের গভীরে প্রবেশ করছে সিগারেটের ধোঁয়ার মত আর মুগ্ধতায় আমার চোখ বুজে আসছে –
and you want to travel with her
And you want to travel blind
And you know that she will trust you
For you’ve touched her perfect body with your mind
এই !!!!!!!! বলে সে আমার কোমরে চাপ দিতেই কোন রকমে কন্ট্রোল করেছি । আরেকটু হলে একটা গাছে ধাক্কা মারতাম । আমার পক্ষীরাজ থেকে নেমে ঠোঁট থেকে মাটিতে পড়ে যাওয়া সিগারেটটা তুলতে যাব সে বলল , তুলছিস কেন ? ফেল । আরেকটা দিচ্ছি ধরা বলেই নিজেরটাও ছুঁড়ে দিল । আমরা হেসে উঠলাম দুজনই । সে গাড়ি স্টার্ট দিল আমি পেছনে বসলাম । কি রে মনে মনে কার শরীর ছুঁয়ে ফেললি ? বলেই আবার হেসে ফেলল । আমরা শহরের দিকে যাচ্ছি । এখন পিচ রাস্তা , দুদিকে শাল গাছ । হাওয়ায় তার এলোমেলো চুল আমার মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে , আর পারফিউম ছুঁচ্ছে চেনা স্মৃতি । এবার আমি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে গাইছি – and jane came by with a lock of your hear…
ভীষণ বোর হচ্ছেন বলুন ? আচ্ছা মাঝের কিছুর সিন কেটে বাদ দিলাম । সামনে ইউনিভার্সিটি । ও বলল – দেখ এক ঝাঁক সুন্দরী আসছে , আমি ওদের সামনে গিয়ে ব্রেক মারি কি বলিস ? আমি বললাম - তারপর ? তারপর আবার কি তুই সেই jannat এর মত দু হাত হাওয়ায় ভাসিয়ে দিবি আর আমি গেয়ে উঠবো ও ও ও ওও ও ওও ও… । হ্যাঁ তারপর একটা জুতো উড়ে আসুক তাই তো ! আমাদের দুজনেরই মুখে সিগারেট আর এভাবে হাসছি দেখে সেই এক ঝাঁক মেয়ে আমাদের দিকে হা করে টিপিকাল ভাবে তাকিয়ে আছে । আমরা হাসতে হাসতে আরো কিছুটা এসেছি । সূর্যের আলো নিভে আসছে । এবার আমি বললাম - চল নদী পাড়ে যাই ।
চারিদিক অন্ধকার । নদী এখানে বাঁক নিয়েছে । শান্ত জল । আমরা উঁচু পাড়ে দুজন দুজনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি । নদীর দিকে মুখ । আরেক হাতে দুজনেরই বিয়ারের বোতল । আমরা কোন কথা বলি নি । আন্ধকারে নিরবতা চিরে শুধু আসছে ঝিঁঝিঁ আর ব্যাঙের ডাক আর বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা করে দিচ্ছে । একটু আগে নদীর ওই পাড়ে দেখা যাচ্ছিল পুরনো মন্দিরের জীর্ণ চূড়া । সেই কবে থেকে যে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক আমাদের মত । এই যেমন আমরা এত কাছাকাছি আসি , হৃদস্পন্দন শুনি অথচ কেউ কাউকে কিছু বলতে পারি না । অবশ্য শত দূরত্ব থাকলেও বুঝে ফেলি একে অপরকে । এক ঘণ্টা আমরা এখানে ছিলাম কিন্তু একটাও কথা বলি নি । তাকে বাড়ি ছেড়ে আমি হাইওয়েতে । এখন রাত ২ : ৩০ । আমার হৃদয়ে তার হাসিমুখ । অন্ধকার ঘরে নীল আলোয় ব্লুজ বাজছে । আমি গুন গুন করছি –
“আকাশে তোমার গন্ধ ভাসে
আমি অন্ধ হতে চাই
আমার শরীর তোমার স্পর্শ খোঁজে
তোমায়, কেবল তোমায় খুঁজে যায় ।“
আমি জানি তুই এখন গাঁজা টেনে শূন্যে । খাটে আধশোয়া অথবা ব্যালকনিতে আরামকেদারায় । অনন্যা , আমি যেমন তোকে , তুইও কি এ মধ্যরাতে আমাকেই মনে করছিস প্রিয় ?
@ রোহন নাম্বিয়ার ।